ঢাকা : দেশের রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নীতিতে গত কিছু দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে কথাবার্তায় মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের সংযত আচরণ, দলীয় নেতা-কর্মীদের শাসানোর পাশাপাশি বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোধগার এবং তাদের ওপর হম্বি-তম্বি না করা অন্যতম ব্যতিক্রম ঘটনা। গত দু’সপ্তাহের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সরকারি দলের নেতারা বিরোধীদল বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেননি। অন্যদিকে জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি ও কয়েকটি বাম দলের অতীত কর্মকাণ্ড টেনে এনে তাদের বিরুদ্ধে বিষোধগারে মেতে রয়েছেন। বিশেষ করে জাসদকে তুলোধুনো করে ছেড়েছেন শেখ সেলিম, মাহবুব উল আলম হানিফ, ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম প্রমুখ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। এর ফলাফল হিসেবে রাজনীতিতে নতুন কথা প্রচারিত হতে শুরু করেছে। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, বিএনপিকে খুশি করতেই নাকি জাসদকে তুলোধুনো করতে হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় শিগগিরই যে কোনো সময় জাসদকে মহাজোট থেকে বের করে বিরোধীদলের কাতারে ঠেলে দেয়া হবে। তাতে হাসানুল হক ইনু মন্ত্রীত্ব হারাবেন। যদি তাই হয়, তাহলে বলতে হবে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এটি একটি শুভ লক্ষণ। শীর্ষ কাগজের বিগত সংখ্যার প্রতিবেদনে এই মর্মে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিলো যে, রাজনীতিতে একটা সুবাতাস আসছে। হয়তো পরিস্থিতি সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। রাজনীতিতে বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হোক এটা দেশের আপামর সকলেই যে চায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অবশ্য, এমন কথাও প্রচার পাচ্ছে, জাসদকে বিরোধীদলের কাতারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে জাসদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই। জাতীয় সংসদে এখন একমাত্র বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। আগামীতে শুধু জাতীয় পার্টি নয়, নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের পছন্দের আরো কয়েকটি শক্তিশালী বিরোধীদল দাঁড় করাতে চায়। তারমধ্যে জাসদ একটি। আর সেই কারণেই নাকি জাসদ নিয়ে মেকি বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।
তবে এই মতামতের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। কারণ, আওয়ামী লীগ সব গুটিই নিজের হাতের মধ্যে রেখে যে খেলবে সেই পরিস্থিতি এখন নেই। আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন বলা যায় ‘বন্ধুশূন্য’ প্রায়। একমাত্র বন্ধু ছিলো ভারত। সেই ভারতের ভূমিকা এখন আওয়ামী লীগের জন্য রহস্যজনকই ঠেকছে। আর তাই বাধ্য হয়ে তাদেরকে এখন বাঁকা পথ ছেড়ে সরল পথে আসতে হচ্ছে। এটা বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার একমাত্র পথ, এখন তারা তা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য পর্দার অন্তরালে এবং উপরের পর্যায়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে সমঝোতা আলোচনা অনেকটাই এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করছে।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ নেতারা বুঝতে পারছেন ইনু, মেননরা তাদের জন্য কল্যাণকর নয়। অতীতে যেমন বঙ্গবন্ধুকে আন-পপুলার এবং পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলো এরা, বর্তমানেও তেমনি আওয়ামী লীগকে বাঘের পিঠে চড়িয়েছে। এরাই মূলত বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী। এদের চরম ভাবাপন্ন কর্মকাণ্ড ও উস্কানি না থাকলে আওয়ামী লীগ ২০১৩ সালেই রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজি হয়ে যেতো। ওই সময় এরা সবেমাত্র নতুন মন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রীত্ব কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি হননি। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সমঝোতা মানেই ক্ষমতাচ্যূত, মন্ত্রীত্ব হারানো। এটা মেনে নিতে পারেননি তারা। আর তাই প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারকদের ভুল বুঝিয়ে সরকারকে চরম পন্থার দিকে নিয়ে গেছেন। সারা দেশে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনো অব্যাহত আছে। এ অস্বাভাবিক অবস্থার অবসান কীভাবে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
আওয়ামী লীগ নেতারা যা বললেন
বিতর্কটা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বক্তব্যের মাধ্যমে। ধানমণ্ডিতে জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনায় শেখ সেলিম বলেন, ‘জাসদই (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নামধারী এই জাসদের নেতাকর্মীরা মুজিববাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও গণবাহিনীতে ছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি এই গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, মানুষ হত্যা ও এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত।’ পরে বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনেও একাত্তর পরবর্তী জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। দলীয়ভাবে জাসদ এসব বক্তব্যের বিষয়ে এক বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।
জাতীয় সংসদ ও বিভিন্ন আলোচনায় এর আগেও শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জাসদকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। চলতি বছরের ২১ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৩৪তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের আলোচনায়ও শেখ সেলিম একই বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে এবারই শেখ সেলিমের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ক্যাপ্টেন (অব.) তাজসহ কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির সঙ্গে জাসদকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
বিব্রত জাসদ
বেশ জমে উঠেছে বলা যায়, আওয়ামী লীগ বনাম জাসদ বিতর্ক। মূলত: আওয়ামী লীগের বিরোধিতা থেকেই যে জাসদের জন্ম হয়েছিলো সেটা সবাই জানেন। ছাত্রলীগের সম্মেলনে নেতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তরুণ মেধাবী অংশ বিদ্রোহ করে জাসদের জন্ম দেয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ এর মূলমন্ত্র নির্ধারণ করা হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। কিন্তু, এই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কী জিনিস তা তারা নিজেরাও জানতেন না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্র নানা নামে বিকশিত হয়। তারমধ্যে নতুন এই নাম আসে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সারা দেশের তরুণদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এই জাসদ নামটি। বলা হয়ে থাকে, জাসদ আদতে ভারতেরই সৃষ্টি। আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবেন না এটা তারা দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলো। আর সেই কারণেই বি-টিম হিসেবে জাসদ সৃষ্টি করেছিলো। যাতে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব অন্যদিকে চলে না যায়। কারণ ভয় ছিলো, চিনাপন্থিরা বঙ্গবন্ধুর বিকল্প হিসেবে আবির্ভুত হতে পারে। সেই ভয় থেকেই দ্রুত জাসদকে নাসিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধুর পরে জাসদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে এটা অনেকটা পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু, মার্কিন চালের কাছে হেরে যায়। জাসদ এক পর্যায়ে অনেকটাই বেসামাল ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। জাসদ নেতাদের উদ্দেশ্যহীন ও নীতিহীন বেসামাল কর্মকাণ্ড তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকেও বেসামাল ও বিপর্যয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। যার পরিণতি ৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।
বলা হয়ে থাকে, একটি সদ্য স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের রোমান্টিক স্বপ্ন নিয়ে উগ্র রোমান্টিক পথটি নিয়েছিলো জাসদ। দলটিকে রাজনৈতিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট হতে দেয়নি। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, নৈরাজ্যের অন্ধকার পথে নিতে গিয়ে সরকারকে অস্থির ও অশান্তই রাখেনি, দলের কর্মীদেরও মৃত্যুর অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়েছে। কর্নেল তাহেরের জন্য জাসদ তার প্রথম অক্টোবর সম্মেলনে সহ-সভাপতির পদটি শূন্য রাখলেও তাকেই গণবাহিনীর প্রধান করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে শ্রেণীবিপ্লবের স্লোগান তুলে সৈনিক সংস্থা গঠন করে গণবাহিনীর সশস্ত্র বিপ্লবের পথে মুজিব সরকার উৎখাতের পথ নিয়েছিল জাসদ।
খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার মতো হঠকারী কর্মসূচি দিয়ে যে জাসদের উগ্র রাজনীতির সূচনা, তার পরিণতি ছিল দেশ ও দলের জন্য বিয়োগান্তক। জাসদের ইতিহাস হয়ে উঠেছিল দল ও দেশের জন্য রক্তাক্ত দলিল। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ‘৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর কর্নেল তাহের ও হাসানুল হক ইনুরা সেনাবাহিনীতে সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী দিয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছেন, ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় তাদের শক্তিকে প্রকাশ্যে এনেছিলেন। ১৫ই আগস্ট না ঘটলেও গণবাহিনী মুজিব সরকার উৎখাতের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলতো। ১৫ই আগস্টের খুনিচক্র আগাম ঘটিয়ে ফেলায় জাসদের বিপ্লবের পরিকল্পনা ৭ই নভেম্বর উন্মোচিতই হয়নি, ভুল ফাঁদেও পড়েছে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় জাসদ। খালেকুজ্জামান, আ ফ ম মাহবুবুল হকরা বাসদ গড়েন। এরশাদ আমলে আ স ম আব্দুর রব এরশাদের গৃহপালিত নেতা হয়ে যান। শাহজাহান সিরাজ আলাদা দল করে মিশে যান বিএনপির সঙ্গে। কাজী আরেফ, হাসানুল হক, শরীফ নূরুল আম্বিয়া এরা মিলে জাসদকে ধরে রাখেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। এই জাসদ, খালেকুজ্জামান, আ ফ ম মাহবুবুল হকের দুই বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, নির্মল সেনের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল মিলে গঠিত পাঁচদলীয় জোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলের সঙ্গে ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আ স ম আব্দুর রবকে নেওয়া হয় মন্ত্রিসভায়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে আব্দুর রব, মঞ্জু চলে যান যে যার পথে। ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর জাসদ যোগ দেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে। আ ফ ম মাহবুবুল হকের বাসদ থেকে এই জাসদে আসেন মাইনুদ্দিন খান বাদল। বহুধাবিভক্ত জাসদের এখন এটিই মূলধারা। তবে এটিও এখন একটি ক্ষয়িঞ্চু দল।
আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর
এটা সবাই জানেন, নৌকায় না উঠলে এই জাসদের কপালে ক্ষমতার স্বাদ জুটতো না। একদিকে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। পাশাপাশি আরেকটি বড় উদ্দেশ্য তাদের হাসিল হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া। এটা তাদের বহুদিনের লক্ষ্য ছিলো। ২০০৯ সালের মহাজোট সরকার যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে সেই সময় মূল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই দ্বিধা-দ্বন্দ্েব ছিলো। নতুন করে রাজনৈতিক বিদ্ধেষ, হিংসা-হানাহানিতে যেতে চাইছিলো না তারা। মহাজোটের বাম দলগুলো এবং আওয়ামী লীগের মধ্যেকার সাবেক সিপিবি অংশ যুদ্ধাপরাধ-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকার সেখানেই থেমে থাকেনি। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন শুরু করে। যার ফল দাঁড়ায় এই, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে নামার মইটি হারিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র মানে, ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা থেকে নামার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দল উভয়টিকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে, এটাই নিয়ম। তাতে তাদের ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার পথও প্রশস্ত হয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলো বলেই ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ তাদের নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করেছিলো। ১৯৯৬-০১ সরকারের সময় সন্ত্রাস ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ থাকলেও রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্ধেষ তেমন একটা ছিলো না বললেই চলে। আর সেই কারণে মানুষ বাকশাল পরিস্থিতি একরকমের ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু, আওয়ামী লীগের মহাজোটের এই আমলটা আবার যেন মানুষকে আতংকগ্রস্থ করে তুলেছে।
আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আশংকা
রাজনীতিতে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘাত, হানাহানি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, চেইন অব কমাণ্ড কেউ মানছে না। হঠাৎ করেই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, দলীয় পদ নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে হানাহানিতে গত দুই মাসে নিহত হয়েছেন দলটির ১৭ জন নেতা-কর্মী।
যদিও এ সব ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ও ‘বৈশ্বিক অস্থিরতার অংশ’ হিসেবেই উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কেউ কেউ। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ লাখ লাখ নেতা-কর্মীর দল। এই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ রকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলোকে সামাজিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ বলে তারা আখ্যায়িত করতে চাচ্ছেন।
কিন্তু, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এটা মানতে নারাজ। তারা মনে করছেন, দলের অভ্যন্তরীণ চরম সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ এগুলো। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বার বার আরেকটি ১৫ আগস্টের আশংকা থেকে সেটাই প্রতীয়মান হয়। সৈয়দ আশরাফ ছাড়াও মোহাম্মদ নাসিমসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা একই আশংকা ব্যক্ত করছেন।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে গেছে। মাঠে এখন প্রতিপক্ষ খুব দুর্বল। প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৫ আগস্টের আগে এমনটাই হয়েছিল। তখন আমরা নিজেরা যুদ্ধ করেছিলাম বলেই মোস্তাকের মতো বেঈমান বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ পেয়েছিল। মোস্তাক আমাদের মধ্যেই ছিল। প্রতিপক্ষকে দুর্বল মনে করে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করি তাহলে আমাদের সামনে বিপদ আসবে।’
খালেদা জিয়ার আহ্বান এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস
সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পর পর দু’টি বিবৃতিতে সরকারের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টি আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের বন্ধ কপাট খুলে দিন। এরপর সর্বশেষ অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, আসুন, আমরা আগের মতো এক সঙ্গে কাজ করি। সরকারের তরফ থেকে সংযত আচরণ এবং পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার স্থগিত লন্ডন সফর নিয়ে এখন আর কথাবার্তা নেই বললেই চলে। তিনি আদৌ লন্ডন সফরে যাবেন কিনা, গেলেও কবে যাবেন, সেটি এখন পুরোপুরিই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলা যায়। বিএনপি নেতারাও এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পর্দার অন্তরালে এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। এই আলোচনার অগ্রগতির উপর নিভর্র করছে সবকিছু। এমনকি খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের কর্মসূচিও। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, খুব শিগগিরই হয়তো বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে আরো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে। কারণ, এ মুহূর্তে উভয় পক্ষের মধ্যেই কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। সূত্র : শীর্ষ নিউজ ডট কম