বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের নেপথ্য নায়ক

0

স্পোর্টস ডেস্ক, ২২ সেপ্টেম্বর : কতবড় বন্ধু হারাল বাংলাদেশ ক্রিকেট? জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যুর পর বার বার ঘুরেফিরে আসছে এ প্রশ্ন। এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না, আবার যাবেও। একবাক্যে বলা যায়, ডালমিয়ার কল্যাণেই ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে বাংলাদেশ। কীভাবে? ছোট এ প্রশ্নের উত্তর বিশাল।

১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সার্কিটে আলোচনায় চলে আসে বাংলাদেশ। বিশ্বক্রিকেট রাজনীতির জটিল অঙ্ক মাথায় নিয়ে বাংলাদেশকে আইসিসির পূর্ণ সদস্য করার ছক আঁকেন ডালমিয়া। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে তখন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী আর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক। আশরাফুল হক বহু বছর ধরে ডালমিয়ার প্রিয়। সাবের চৌধুরীর সঙ্গেও অল্পদিনে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জগুদা। সাবের-আশরাফুলকে নিয়ে শুরু করেন বাংলাদেশকে টেস্ট খেলুড়ে করার আপাত অসম্ভব মিশন।

তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যাট-বলের পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়া কঠিন। তাই তারা তুলে আনলেন ভিন্ন মানদণ্ড, যাতে বার বার প্রমাণ হতে থাকল বাংলাদেশের সাংগঠনিক যোগ্যতা আর সাধারণ মানুষের ভালোবাসা।

বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের বছরেই বিশ্বক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সভাপতি হন ডালমিয়া। দেখলেন আইসিসির আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। অ্যাকাউন্টে মাত্র ২৫ হাজার ডলার। আর ক্রিকেটকে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে ছড়িয়ে দিতে দরকার টাকা। আইসিসির অ্যাকাউন্টের দুর্বল অবস্থাটাকেও বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেন কৌশলী সংগঠক ডালমিয়া। মূলত শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত তৎকালীন আইসিসি কর্তাদের তিনি বোঝালেন, বাংলাদেশ ১৫ কোটি মানুষের বাজার। এই বাজারকে মূল স্রোতে আনতে পারলে আইসিসির ভাণ্ডারে জমা হতে পারে বহু অর্থ। ডালমিয়া জমানাতেই টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করতে শুরু করে আইসিসি। তাইতো, ২০০০ সালে আইসিসি ছাড়ার সময় অ্যাকাউন্টে রেখে গেলেন ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আইসিসির আয় বাড়াতে ডালমিয়ার নেওয়া নানা উদ্যোগের প্রথমটি বাস্তবায়িত হলো ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। আইসিসির সবক’টি টেস্ট খেলুড়ে দেশ নিয়ে তিনি চালু করলেন মিনি বিশ্বকাপ, যা আজ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচন করা হলো বাংলাদেশকে। আগে এশিয়া কাপ আয়োজন করলেও এতবড় টুর্নামেন্ট আয়োজনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছিল না। কিন্তু সাবের-আশরাফুলে আস্থা রাখলেন ডালমিয়া। সঙ্গে বিসিবির একদল অন্তপ্রাণ সংগঠক। নিজেদের টেস্ট স্ট্যাটাস না থাকলেও দুর্দান্ত আয়োজনে সবক’টি টেস্ট খেলুড়ে দেশকে মুগ্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। এতকিছু সম্ভব হতো না, যদি মাথার ওপর না থাকতেন ডালমিয়া। বিসিবির প্রতিটি সমস্যার হাসিমুখে সমাধান দিয়ে পাশে ছিলেন জগুদা। এমনকি মাঠ সংস্কারের জন্য রোলার আর সুপার সপার পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সড়কপথে ট্রাকে করে রোলার-সুপার সপার এসেছিল ঢাকায়।

ওয়ার্ল্ড টেলের কাছে সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে আয় করেছিলেন লাখ ডলার। তাই টুর্নামেন্ট আয়োজনের বিপুল ব্যয় নিয়ে মোটেও ভাবতে হয়নি বিসিবিকে। আইসিসির টাকায় গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে আতিথেয়তা নিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ তুলে ধরে বাংলাদেশ।

১৯৯৯ সালে ডালমিয়ার আরেক নতুন প্রজেক্ট এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। অংগ্রহণের সুযোগ না থাকলেও ফাইনালের স্বাগতিক করে বাংলাদেশকেও জড়িয়ে রাখলেন এ টুর্নামেন্টের সঙ্গে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপ পর্বে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি হয়েছিল কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন্সে। দেখেছি, আইসিসি সভাপতি হয়েও ডালমিয়া প্রতিদিন প্রেসবক্সে এসে সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতেন। আলাদাভাবে কথা বলতেন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গেও। মার্চে ফাইনালের দারুণ আয়োজন করে আরেকবার নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। টেস্ট ম্যাচেও গ্যালারিতে হাজার হাজার দর্শক, নজর কাড়ে ক্রিকেটবিশ্বের।

১৯৯৯ সালের জুনে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে নিজেদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের পরিচয় দেন আমিনুল-দুর্জয়-আকরাম-বুলবুলরা। সাংগঠনিক সাফল্যের পাশাপাশি ময়দানি সাফল্য, জোড়ালো হয়ে ওঠে বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার দাবি। এশিয়ার তিন দেশ_ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সাদা কর্তারা এত সহজে সমর্থন দিতে রাজি নন। সাবের-আশরাফুলদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন ডালমিয়া। সে সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জন হাওয়ার্ড। হাওয়ার্ড দারুণ ক্রিকেটভক্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যে ক্রিকেট দারুণ পছন্দ করেন, ততদিনে তা বুঝে গেছেন চৌকস সংগঠক ডালমিয়া। অস্ট্রেলিয়াকে রাজি করাতে ডালমিয়া-সাবের প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হলেন। সব শুনে শেখ হাসিনা ফোন করলেন হাওয়ার্ডকে। বাকিটা ইতিহাস। ২০০০ সালের জুনে লর্ডসে আইসিসি সভায় সর্বসম্মতভাবে টেস্ট মর্যাদা পেল বাংলাদেশ।

২০০৯ সালে আশরাফুল হকের মেয়ের বিয়েতে যোগ দিতে সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিলেন ডালমিয়া। তখন একান্ত সাক্ষাৎকারে এই লেখককে বলেছিলেন, এশিয়ার তিন দেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হবে। মাশরাফি-সাকিবরা যেদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন, সেদিন শান্তি পাবে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ডালমিয়ার আত্মা।

Share.
মন্তব্য লিখুনঃ

 

',