ঢাকা, ২১ সেপ্টেম্বর : ঈদের বাকি আর তিন দিন। তাই রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালমুখী জনস্রোত বাড়ছে। নাড়ির টানে ইট-পাথরের মহানগর ছেড়ে পরম শান্তির নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। কিন্তু আনন্দের এ যাত্রার শুরুটা হয়েছে দুর্ভোগের মধ্য দিয়েই।
গতকাল রোববার সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে ঘরমুখী মানুষকে সইতে হয় বিড়ম্বনা। সঙ্গে রাজধানীর চিরচেনা অসহনীয় যানজট তো ছিলই। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরমুখী মানুষের মিছিলও দীর্ঘ হতে থাকে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনালে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। পাশাপাশি পরিবহন কোম্পানিগুলোর কাউন্টারেও অসংখ্য মানুষ নির্দিষ্ট বাসের অপেক্ষায়। অপেক্ষার কারণ, যাত্রী আছে, গাড়ি নেই। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃষ্টি আর মহাসড়কের পাশে পশুর হাট ও পশুবোঝাই ট্রাকের কারণে রাজধানীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে গাড়ি পৌঁছাতে ও ছাড়তে দেরি হচ্ছে। ফলে বাসের অপেক্ষায় যাত্রীদের দীর্ঘ সময় পার করতে হয় টার্মিনাল-কাউন্টারে। এরপর একটি গাড়ি এলেই অন্তত তিন গাড়ির অগ্রিম টিকিট হাতে নিয়ে হাজির যাত্রীরা। অনেক ক্ষেত্রে গাড়িতে উঠতে যাত্রীদের ধস্তাধস্তি করতেও দেখা যায়।
এদিকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের নেতৃত্বাধীন বিআরটিএর মনিটরিং টিম গতকাল তিনটি টার্মিনাল পরিদর্শন করে। আজ দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় পরিবহন ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
যাত্রীরা জানান, টিকিট সংগ্রহের দুর্ভোগের পর এবার লড়াই গাড়িতে উঠতে পারার। মহাসড়কে যানজটের কারণে কোনো গাড়িই সময়মতো টার্মিনালে আসতে পারছে না। মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারক টিম রয়েছে ঠিকই; কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নেই। বিশেষ করে টাঙ্গাইল মহাসড়কের যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলে ধীরগতিতে। ফলে গতকাল সকাল থেকে এ রুটের যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে দেখা যায়।
একাধিক যাত্রী জানান, বৃষ্টিতে রাজধানীজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এরপর টার্মিনালে অপেক্ষা। মহাসড়কেও যানজট। এই পুরনো চিত্র আর কতকাল? আর গাবতলী টার্মিনালে তো যেতেই দুর্ভোগ। তীব্র যানজটের কারণে কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল মোড়ের সামনে নেমে হেঁটে যেতে হয়।
এদিকে যাত্রার সময় টিকিট বিক্রি হয় মহাখালী বাস টার্মিনালে। সেখানেও রাখা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। আর যাত্রীরা বাধ্য হয়েই সে ভাড়া মিটিয়ে যাত্রা করছেন গন্তব্যে। অন্যদিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা যাতায়াত করে থাকেন। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে, মোড়ায় বসে অথবা ছাদে চেপেও রওনা হন অনেকে। তবে গাড়িতে চড়তে পারাই শেষ নয়। পথে রয়েছে খানাখন্দ আর যানজট।
এদিকে গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ট্রেনের ঈদযাত্রী পরিবহন। যাত্রীচাপও ছিল বেশি। ঘরমুখী মানুষ নিয়ে ছুটে চলা ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকারও জায়গা ছিল না। খালি ছিল না ছাদও। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনের ছাদে যাওয়ার সুযোগ কম। তবু গতকাল ছাদে অনেক যাত্রী দেখা যায়। আর বিমানবন্দর স্টেশনের পর ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ঝুঁকি নিয়েই ছাদে, ইঞ্জিনের সংযোগস্থলে চেপে বসেন যাত্রীরা।
কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ জোরগতিতে পা চালাচ্ছেন স্টেশনের প্লাটফরমের দিকে। আছেন বৃদ্ধরাও। কখন যাবেন প্রিয়জনের কাছে- সেই ব্যাকুলতায় এবার ট্রেনে ওঠার যুদ্ধে তারা। কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যের ট্রেনের। কাক্সিক্ষত ট্রেন আসা মাত্রই দৌড়। অগ্রিম টিকিট কেনার জন্য যেমন সংগ্রাম করতে হয়েছে, এবার ট্রেনে চড়ার ক্ষেত্রেও তেমন। তবে ট্রেনের ভেতরের অপরিচ্ছন্নতা দেখে হতাশ হন অনেক যাত্রী। গতকাল নির্ধারিত সময়ের এক থেকে আড়াই ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন। প্রথম দিনে এসব ট্রেন দেরিতে ছাড়ায় বাকি চার দিনও শিডিউল ঠিক রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। কারণ কোনো ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয় দেখা দিলে পরের দিনগুলোতে সেটি ঠিক রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে।
বিকাল ৩টায় কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শন শেষে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রা নিশ্চিতে অতিরিক্ত বগি, ইঞ্জিন ও রিলিফ ট্রেন নির্দিষ্ট স্টেশনে মজুদ রাখা হয়েছে। সব ট্রেনই ঠিকমতো এসেছে। নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছে। দু-একটি ট্রেন কয়েক মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে ২৭০টি যাত্রীবাহী বগি রেলওয়ে বহরে যোগ হবে। ফলে আগামী ঈদে অতিরিক্ত আরও যাত্রী বহন করা সম্ভব হবে। যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট কাটতে পারেননি, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যাত্রার দিন আসনবিহীন ১৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে স্টেশনের ট্রেন সিগন্যাল রেজিস্ট্রার (টিএসআর) খাতায় দেখা গেছে, এদিন ভোর ৫টা ২০ মিনিট থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৩৪টি ট্রেন ঢাকা থেকে ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে ঢাকা-খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ের ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ১ ঘণ্টা দেরিতে, রাজশাহী এক্সপ্রেস ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট এবং ঢাকা-চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী প্রায় ১ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে।
এদিকে ট্রেনের ছাদে ঝুঁকি নিয়ে চেপে বসা প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, ছাদে যাত্রী না নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাত্রীদেরও অনুরোধ করা হচ্ছে, ঝুঁকি নিয়ে ছাদে না চড়তে। আর রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. খলিলুর রহমান জানান, বৃষ্টির দিন হওয়ায় ট্রেন নির্দিষ্ট গতির চেয়ে কিছুটা ধীরগতিতে চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে গতকাল থেকেই লঞ্চ টার্মিনালে মানুষের ভিড় ছিল। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে। তবে আবহাওয়ার কারণে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাইয়ের হার তুলনামূলক কম ছিল। তবে সব রুটের লঞ্চেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল সূত্রে জানা যায়, শতাধিক বেসরকারি লঞ্চ গতকাল ছেড়ে যায় ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। প্রায় ৯ হাজার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়। পাশাপাশি চলছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) বিশেষ স্টিমার সার্ভিস। গত বছর ঈদুল ফিতরের সময় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির পর এবার ছোট লঞ্চ ও অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চ চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা জানায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় গতকাল তৎপরতা দেখা গেছে বিআইডব্লিউটিএ ও লঞ্চমালিকদের।