স্পোর্টস ডেস্ক, ৯ সেপ্টেম্বর : ক্রিকেট ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর সেরা বল কোনটি? যারা একটু খবর রাখেন তারা বলবেন, শেন ওয়ার্নের সেই বলটি। যেটা ১৯৯৩ সালে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে মাইক গ্যাটিংয়ের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে বোল্ড করে ফিরিয়েছিল। খাতা-কলমেও শতাব্দীর সেরা বল মনে করা হয় ওয়ার্নের হাত থেকে বের হওয়া ওই ডেলিভারিকে। আগ থেকেই এ বিষয়টি নিয় বিতর্ক আছে। তবে বিষয়টি ফের আলোচনায় আনলো ‘ক্রিকইনফো’।
তারা পাঠকদের দৃষ্টিতে শতাব্দীর সেরা বল নিয় মতামত জানতে চেয়ে একটি জরিপ চালাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। মতামত প্রদানকারীদের বাছাইকৃত মন্তব্যও প্রকাশ করেছে ক্রিকইনফো। ইতিমধ্যে তারা ১২টি সেরা মতামত প্রকাশ করেছে। এরমধ্যে ৪ জনই পাকিস্তানের গতির রাজা শোয়েব আখতারের কোনো কোনো ডেলিভারিকে শতাব্দীর সেরা বল মনে মত দিয়েছেন।
এছাড়া ওয়াসিম আকরাম, কার্টলি অ্যামব্রোস, ড্যারেন গফ, মুত্তিয়া মুরালিধরন, ডেল স্টেইন ও রবিচন্দ্রন অশ্বিসের নির্দিষ্ট কোনো ডেলিভারিতে শতাব্দীর সেরা বলেছেন। অসি কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নের ওই বলটিকেও শতাব্দীর সেরা বলেছেন বারো জনের একজন। ক্রিকইনফো’য় প্রকাশিত ১২ মতামতে ওয়াকার ইউনুস কিংবা সাকলায়েন মুশতাকের কোনো ডেলিভারি জায়গা পায় নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকায় ক্রিকইনফোতে আলাদা বিশাল একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছেন ক্রীড়া লেখক সাদ সুলতান। তার যুক্তি আবার ভিন্ন। শেন ওয়ার্নের ওই ডেলিভারিকে তিনি শতাব্দীর সেরা মানতে নারাজ। এরপক্ষে তিনি যুক্তিও দেখিয়েছেন বেশ। তবে ওয়ার্নের ওই ডেলিভারিকে অবশ্যই তিনি সেরা ডেলিভারির একটি মনে করেন। কিন্তু পাকিস্তানের সুলতান অব সুইং ওয়াকার ইউনুসের একটি ডেলিভারিকে শতাব্দীর সেরা মনে করেন। যে ইয়র্কার ডেলিভারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারা বোল্ড হয়ে ফিরেছিলেন।
অবশ্য ওয়াকারের এই ডেলিভরির চেয়ে ওয়াসিম আকরামের একটি ডেলিভারিকে তিনি আরও সেরা মনে করেন। কিন্তু আকরামের সেই ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যান বোল্ড হলেও আউট হননি। এছাড়া আকরামের বলে আউট হওয়া ওই ব্যাটসম্যানও তেমন নামকরা কেউ ছিলেন না। শতাব্দীর সেরা বল নির্বাচন করতে গিয়ে শুধু ডেলিভারি নয়, বরং আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের অবস্থানও তিনি বিবেচনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ওয়াসিম আকরামের একটি ডেলিভারিকেই তিনি শতাব্দীর সেরা মনে করেন। যে ডেলিভারিতে আউট হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ডমিনিক কর্ক। বলটি ডাবল সুইং করে তার স্টাম্প উপড়ে ফেলে। যা ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই বলটিকে শতাব্দীর সেরা বলা যাচ্ছে না কয়েকটি কারণে।
প্রথমত, ওই বলে ব্যাটসম্যানকে আউট দেয়া হয় নি। দ্বিতীয়ত, ব্যাটসম্যান ছিলেন অ্যখ্যাত কর্ক। তৃতীয়ত, আকরামের ওই বলটি কর্কের ব্যাটের কানা হালকা স্পর্শ করে। অন্যদিকে শেন ওয়ার্নের ১৯৯৩ সালের ওই ডেলিভারির চেয়ে ওয়াকার ইউনুসের ১৯৯৭ সালের ডেলিভারিকে এগিয়ে রাখার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রতিপক্ষ দুই ব্যাটসম্যানের অবস্থান। ওয়ার্নের বলে আউট হয়েছিলেন মাইক গ্যাটিং। আর ওয়াকারের বলে আউট হন ব্রায়ান লারা। এছাড়া ওয়ার্নের ওই ঢেলিভারিটি ফ্লুক ছিল বলে নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু ওয়াকারের বলটি তেমন ছিল না। বরং পরিকল্পিতভাবে লারাকে ইয়র্কার বল দিয়ে বোল্ড করে ফেরান। ওয়ার্নের বলটি পড়েছিল লেগ স্টাম্পের বাইরে। গ্যাটিং ভেবেছিলেন বলটি লেগ সাইড দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ঘটেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা।
সাপের মতো ফনা তুলে অবিশ্বাস্য বাঁক নিয়ে গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্পে ছোবল মারে বলটি। গ্যাটিং অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বোকার মতো প্যাভিলিয়ানে ফেরেন। ২০১৩ সালে ওয়ার্ন নিজেই জানান বলটি তিনি ওভাবে করতে চাননি। তবে অবিশ্বাস্যভাবেই সেটা অমন হয়ে গিয়েছিল। তার এই স্বীকারোক্তিতে ওই ডেলিভারির মানটা অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে রাওলপিন্ডিতে ব্রায়ান লারাকে ওয়াকার ইউনুসের আউট করার ঘটনাটি ছিল আরও চমকপ্রদ। ওয়াকারকে টানা দুই বলে চার মেরে অভ্যর্থনা জানান লারা। তৃতীয় বলটিও চারের জন্য মারেন। প্রথম তিন বলেই ১০ রান নিয়ে ফেলেন লারা। কিন্তু চতুর্থ বলটি অবাক করে দেয় লারাকে। ওয়াকারের বলটি আসতে দেখে ব্যাকফুটে ভর দেন লারা। ভেবেছিলেন এভাবেই খেলা যাবে। কিন্তু হঠাৎ বলের চরিত্র পাল্টে যায়।
বলটি লারার ব্যাট-প্যাডের সামনে গিয়ে পড়ে। এবার দেখা যায় বলটি ইয়ার্কার। লারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কোনো রকমে বাঁচি-মরি করে ব্যাট দিয়ে বল ঠেসে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে ব্যাট-প্যাড গলে লারার স্টাম্প উপড়ে ফেলে বলটি। লারা আউট হন ১৫ রানে। ওয়াকার ইউনুসের এই ডেলিভারিকেই শতাব্দীর সেরা মনে করা হচ্ছে।
শেন ওয়ার্নের চেয়ে ওয়াকার ইউনুসের ডেলিভারিকে সেরা মনে করার কারণ আরও আছে। বিবেচনা করা হচ্ছে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে। মাইক গ্যাটিং অনেক বড় ব্যাটসম্যান। কিন্তু টেস্টে তার ব্যাটিং গড় মাত্র ৩৫.৫৫। ৭৯ টেস্টে করেছেন ৪৪০৯ রান। অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার টেস্টে ব্যাটিং গড় ৫২.৮৮। ১৩১ টেস্টে ৩৪ সেঞ্চুরি ও ৪৮ ফিফটিতে তার রান ১১৯৫৩।
টেস্টের এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৪০০ রানের অপরাজিত ইনিংস এখনও তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে। লারার পর্যায়ে গ্যাটিং পৌছতে পারেন নি বলে মনে করেন তিনি। তাই বড় ব্যাটসম্যানকে বোকা বানানোয় বড় স্বীকৃতি জুটতেই পারে।