ঢাকা, ১০ অক্টোবর : দিন কয়েক আগেই দেশ পত্রিকায় তার ধারাবাহিক আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন, আটের দশকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় গিয়ে ভারত কীভাবে নাজেহাল হয়েছিল! মেলার থিম ভারত, ভারতীয় প্রকাশনা-স্টলগুলির ব্যবস্থাপনায় সরকারি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। কিন্তু তারা নিজেরাই কী স্টল হবে, থিম কান্ট্রিকে কী ভাবে তুলে ধরতে হবে খবর রাখেনি।
গত ২ অক্টোবর সেই দেশ পত্রিকা বেরোনোর সময় তিনি হাসপাতালে, ক্যান্সার ক্রমশ ঝাঁঝরা করে ফেলেছে ফুসফুস। অতঃপর সপ্তাহ কাটেনি, শুক্রবার দুপুরে নার্সিংহোমে মারা গেলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। রেখে গেলেন স্ত্রী, দুই কন্যাকে। বয়স হয়েছিল ৭৮। বাংলা প্রকাশনা জগৎ তাকে বাদল বসু নামেই চিনত, আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশক ছিলেন। আত্মজীবনীর নামই ‘পিওন থেকে প্রকাশক’। বাংলা বইয়ের প্রকাশক হিসেবেই লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট যেতেন তিনি।
ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত দহিজুড়ি এলাকায় জীবন শুরু, কাকার হাত ধরে গৌরাঙ্গ প্রেসে সাইকেল পিওন হিসেবে যোগদান ইত্যাদি অনেক কিছুই সেই ধারাবাহিকে লিখছিলেন তিনি। বাদল বসু প্রকাশক হিসাবে কেমন, তার বলিষ্ঠ, কালো চেহারায় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে কী ভাবে বইমেলায় আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে বসে থাকতেন সেটি বড় কথা নয়। নিষ্ঠা ও দক্ষতাকে সম্বল করে মফস্সলের সাধারণ ছেলে কী ভাবে প্রকাশনা জগতের শীর্ষে পৌঁছতে পারে, তার চমকপ্রদ উদাহরণ।
সম্ভবত, তার বন্ধু-বাৎসল্য এই নিষ্ঠারই অন্য দিক। বাংলা বাজারে বটতলার আমল থেকে লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক বিশেষ ভাল নয়। মানিক থেকে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, সকলে প্রকাশকের কাছে টাকা চাইতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতেন, জানা কথা। কিন্তু বাদলবাবু কখনও সমরেশ বসুকে কলকাতায় দ্বিতীয় সংসার পাততে সাহায্য করছেন, কখনও রানি চন্দের কাছ থেকে কুটুমকাটামের ছবি তুলে আনছেন। সুনীল, শক্তিরা এক জায়গায় কবিতা পড়তে গিয়েছেন, বাদল গিয়েছেন বন্ধু হিসাবে। ফেরার পথে ট্রেনে শক্তি মদে চুরচুর, এক মহিলার কোলে প্রায় হেলে পড়েছেন। লোকজন এই মারে তো সেই মারে। বন্ধুরা জানান দিলেন, ‘জানেন, উনি কে? শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ এক সহযাত্রী: ‘কোন শক্তি? অবনী বাড়ি আছ?’ বাদল বসু প্রকাশক ঠিকই, তার চেয়েও তিনি লেখক এবং কবিদের বন্ধু। তিনি কবি সম্মেলনে যান, নানাবিধ দরকারে তাকে ছোট ছোট চিরকুটে চিঠি পাঠানো যায়! ‘‘যাবতীয় চিঠি, ডকুমেন্ট খুব যত্নে রাখত। এই গুছিয়ে রাখা ব্যাপারটা ওর স্বভাবেই ছিল,’’ স্মৃতিচারণ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের।
গুছিয়ে রাখা, ঠোঁটকাটা, সাহসী এবং দায়িত্বের ব্যাপারে পিছু না হঠা। ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর সবিতেন্দ্রনাথ রায় বয়সে বাদলবাবুর থেকে বড়, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি সে বার বইমেলার আয়োজক ‘বুক সেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড’-এর সভাপতি, বইমেলায় আগুন লাগল। ‘‘বাদলবাবু ছাড়া সে দিন কেউ পাশে দাড়াননি, উনি না থাকলে আগুনে পোড়ার দু’দিনের মধ্যে মেলার মাথা তুলে দাঁড়ানো শক্ত হত,’’ বলছিলেন সবিতেন্দ্রনাথ বাবু।
গোছানো স্বভাব, নিষ্ঠা আর বন্ধুবাৎসল্যই তাকে আলাদা করে রেখেছিল অন্যদের চেয়ে। বাদল বসু তাই কোনওদিন মাত্রা ছাড়াননি, বেহেড হননি। ‘‘বন্ধুরা অনেকেই মাতাল হত, কিন্তু বাদল তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিত,’’ বলছিলেন শীর্ষেন্দু। এখানেও কি থেকে গেল না নিজেকে আড়ালে রেখে লেখকের বন্ধু এক প্রকাশক?
বাংলা প্রকাশনা জগতের কত খুচরো টীকাটিপ্পনিই না ধরা রইল তার আত্মজীবনীতে। সত্যজিৎ রায় বলতেন, তার সংসার চলে বই লিখে। বাদলবাবুর আত্মজীবনীতে আছে, ‘বাদশাহি আংটি’ বেরোনোর পর সত্যজিৎকে চেক দিতে গিয়েছেন। লেখক অবাক, ‘সে কি, লিখে টাকা পাওয়া যায় না কি?’ কলেজ স্ট্রিটে পেশাদারিত্বের উত্থানের সঙ্গে এ ভাবেই জড়িয়ে ছিলেন তিনি।
সেই পেশাদারিত্বের বলেই মৃত্যুর আগে শেষ করেছিলেন তার ধারাবাহিক আত্মজীবনী। ফ্রাঙ্কফুর্ট-অধ্যায় শেষ নয়, কেমোথেরাপি নিতে যাওয়ার আগে শেষ কিস্তিও লিখে গিয়েছিলেন প্রকাশক! সূত্র: আনন্দবাজার